রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪

সিজদাহ্ (ছোট গল্প)


⬛
মতিউর রহমান সাহেব এলাকায় সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে তাঁর দারুণ সুনাম। তাঁর উপজেলায় দল-মত নির্বিশেষে যে কেউ যেকোনো সময় তাঁর কাছে সাহায্য চেয়ে খালি হাতে ফেরত যায়নি কখনো। আল্লাহওয়ালা মানুষ। ৬ বার হজ করেছেন। এছাড়াও বছরে দুই-একবার স্বপরিবারে ওমরাহ করেন।
যদিও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেননি, তবে জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত। তাঁর এলাকা ঐতিহাসিকভাবেই আওয়ামী বিরোধী ঘাঁটি। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠনের আগে পর্যন্ত এই এলাকায় খুব কমসংখ্যক নেতা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন, মতিউর রহমান সাহেব তাঁদের অন্যতম। কয়েকবার তাঁর সাংসদ হওয়ার সুযোগ এলেও তিনি সুযোগ নেননি একবারও। কারণ, প্রতিবারই তাঁর মনে হয়েছে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। তিনি আল্লাহর কাছে জবাব দিতে পারবেন না। নিশ্চিত বিজয় জেনেও তিনি নির্বাচন করেননি। আবার আওয়ামী লীগের রাজনীতিও ছাড়েননি। দলটাকে তিনি ভালোবাসেন। নির্বাচনে অন্য প্রার্থীর হয়ে তিনি দুই হাতে টাকা খরচ করেছেন, প্রশাসনের সাথে লিয়াজো করেছেন, ভোটের আগের ও পরের রাত জেগে দলের জন্য যা যা করার তিনি করেছেন। দলটাকে তিনি ভালোবাসেন। দলের হয়ে কোনো অন্যায়কে তিনি তেমন গুরুতর অন্যায় মনে করেন না। প্রতিবার নামাজের সিজদায় তিনি তাঁর কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান, তাঁর দলের জন্য দোয়া চান, দেশের জন্য দোয়া চান।
১৫ই জুলাই রাতে তিনি স্বপরিবারে ওমরাহ থেকে ফিরলেন। ঢাকা থেকে মফস্বলের তাঁর বাসায় আসতে আসতে ১৬ই জুলাই ভোর হয়ে গেছে। ফজরের নামাজ আদায় করে তিনি দীর্ঘ ঘুম দিলেন। তাঁর যখন ঘুম ভাঙল, তখন ভরদুপুর। জোহরের ওয়াক্ত যায় যায়। মতিউর রহমান সাহেব হন্তদন্ত হয়ে ওজু সেরে নামাজে দাঁড়ালেন। এক পর্যায়ে রুকু করে সিজদায় মাথা রাখতেই তিনি প্রচণ্ড উত্তাপে এক প্রকার ছিটকে গেলেন। তিনি কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না যে কী হলো তাঁর সাথে? তাঁর নামাজ ছুটে গেছে। তিনি সিজদার জায়গায় হাত রাখলেন, এবং সেটা খুবই স্বাভাবিক। মখমলের জায়নামাজ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ, অনেকটা শরৎকালের ভোরের মতো স্নিগ্ধ এবং শান্ত। তিনি আবার নামাজ শুরু করলেন। খুশু-খুজুর সাথে তাকবির, সানা, কিরাত, রুকু শেষ করে সিজদা। কিন্তু এবারও প্রচণ্ড উত্তাপে আবার ছিটকে গেলেন। এত উত্তাপ; তাঁর কাছে মনে হলো এ পৃথিবীতে এত উত্তাপ হতে পারে না। এবার তিনি ভয়ংকর বিভ্রান্ত হলেন। বুঝতে পারলেন না, কী হচ্ছে তাঁর সাথে।
তিনি অন্য ঘরে অন্য জায়নামাজ নিয়ে আবার নামাজে দাঁড়ালেন এবং একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলেন। ইতিমধ্যে জোহরের ওয়াক্ত শেষ। তিনি ভাবলেন, জোহর ও আসরের মাঝে খুব সামান্য একটা সময় নামাজের জন্য মাকরূহ সময় থাকে, তিনি হয়তো সেই সময় নামাজ আদায় করছিলেন বলে এমনটা হচ্ছে। খুব অল্প বয়স থেকেই তিনি নামাজ পড়েন এবং নামাজ কাজা করার ইতিহাস তাঁর কমই আছে। এইসব ভেবে তিনি দুপুরের খাবার খেতে গেলেন। বাসায় কুরবানির গরুর মাংস রান্না হয়েছে। মুখে দিতেই তিনি ভিন্ন স্বাদ পেলেন। কেমন জানি ঘামের গন্ধ, রক্তের গন্ধ এরকম মনে হচ্ছে। তিনি ঠিকমতো খেতে পারলেন না। কয়েকটা লোকমা কোনোরকমে গিলেই তিনি মসজিদের দিকে রওনা দিলেন।
এই মসজিদটি তিনিই করে দিয়েছেন। তাঁর বাবা ফজলুর রহমানের সাথে মিলিয়ে মসজিদের নাম রেখেছেন বায়তুল ফজল মসজিদ। মফস্বল শহরের এমন মসজিদ মেলা ভার। তিনতলা মসজিদ, পুরোটাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আর মার্বেল পাথরের মেঝে, দারুণ নকশা করা একাধিক মিনার। জানাজা আর ঈদের নামাজের জন্য বিশাল মাঠ, তাও আবার চারিদিকে ঘেরা। অনেকগুলো দোকান মসজিদের আওতায়। এর আয় দিয়েই মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন আর খতিবদের বেতন ছাড়াও বছরের কয়েকটা মাহফিল হয়। মসজিদে এখনো আসরের আজান না হলেও মতিউর রহমান সাহেব মসজিদের দিকে আসছে দেখে দলে দলে মানুষ মসজিদের দিকে আসছে। কারণ তিনি সদ্য উমরাহ করে এসেছেন। লোকজন তাঁর সাথে কোলাকুলি করার জন্য ছোটাছুটি করছেন।
মতিউর রহমান সাহেব অন্য সময় এই ব্যাপারটা খুবই উপভোগ করতেন। কিন্তু আজ তিনি অস্বস্তি বোধ করছেন। তিনি যার হাত ধরছেন, যার সাথেই কোলাকুলি করছেন সবাইকে তাঁর মৃত মানুষের মতো ঠান্ডা মনে হতে লাগল। তাঁর গা গুলিয়ে আসতে লাগল। ইতিমধ্যেই আজান হয়ে গেছে। তিনি একপ্রকার ঠেলে ঠুলে মসজিদে ঢুকে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। আগে তাঁকে জোহরের কাজা নামাজ আদায় করতে হবে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মসজিদ, দামী কার্পেট আজ একটু বেশী ঠান্ডা মনে হচ্ছিল। এবার তিনি নামাজে কোনোভাবেই খুশু-খুজু আনতে পারলেন না। নামাজে দাঁড়াতেই তাঁর আতঙ্ক শুরু হয়ে গেল। তিনি আতঙ্ক নিয়েই কিরাত করে রুকু করলেন। সিজদায় গিয়ে আবার একই পরিণতি। সিজদার স্থান প্রচণ্ড গরম। কপাল ছোঁয়ানো যাচ্ছে না। তিনি ছিটকে গেলেন আর জ্ঞান হারালেন।
লোকজন ধরাধরি করে তাঁকে বাসায় নিয়ে এলেন। তাঁর জ্ঞান ফিরেনি। ডাক্তার এসে তাঁকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কিছুই পেলেন না। তাঁর প্রেসার ঠিক আছে, পালস ঠিক আছে। শরীরের তাপমাত্রা ঠিক আছে। কিন্তু তাঁর জ্ঞান ফিরেনি। ডাক্তার খুব দ্রুততার সাথে ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট এনে তাঁর রক্ত পরীক্ষা করালেন। তাঁর লিপিড প্রোফাইল, ক্রিয়েটিন, ডায়াবেটিস থেকে শুরু করে সবকিছু ঠিক আছে। ডাক্তার তাঁর কোনো সমস্যা খুঁজে পেলেন না। উমরাহ হজ থেকে আসা অবধি তিনি টিভি কিংবা স্মার্টফোন খুলে দেখেননি। তৎক্ষণাৎ রাজনীতি সম্পর্কে কোনো খোঁজ তিনি এখনো পাননি। ডাক্তার কিছু ধরতে না পেরে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিলেন।
লম্বা সময় পর তাঁর জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না কী হয়েছে। তিনি নিজেকে চিনতে পারলেন না, অন্য কাউকেই চিনতে পারলেন না। তাঁর কেবল মনে হতে লাগল, তাঁকে নামাজ পড়তে হবে, জোহরের নামাজ। তাঁর মনে হতে লাগল, তাঁর নাম আবু সাঈদ। তাঁর মনে হতে লাগল, তাঁকে নামাজ পড়তে হবে, জোহরের নামাজ। তিনি হাসপাতালের কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে দেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে। তাঁর মনে হতে লাগল, তাঁর সিজদার জায়গায় আল্লাহ দোজখের একটা টুকরো রেখে দিয়েছেন। তাঁর মনে হলো, তাঁর দুই হাত প্রসারিত করে বুক পেতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। তাঁকে পুলিশ গুলি করবে। তারপর তিনি জোহরের নামাজ আদায় করতে পারবেন। সিজদা দিতে পারবেন।

© রি হোসাইন 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন